Monday, December 25, 2017

Blog Administrator

রুম কে? আমেরিকা না রাশিয়া, অর্থোডক্স না ক্যাথোলিক - ঐতিহাসিক ও ধর্মতাত্ত্বিক পর্যালোচনা (১ম অনুচ্ছেদ)


রুম কে ? আমেরিকা কেন্দ্রিক জোট নাকি রাশিয়ান কেন্দ্রিক জোট? এটা এখন সব চেয়ে বড় একট বিবাদের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে, একে কেন্দ্র করে শাইখ ইমরান হোসেন কে খুব মন্দ ভাষায় ব্যঙ্গ করা হয়েছে, ফেইসবুকে যারাও শেষ জামানা নিয়ে স্টাডি করেন তারা এই ইস্যুতে কখনো একমত হয়নি। যাইহোক এটা জানার জন্য অনেক বিষয় গুলো পর্যালোচনা করতে হবে। কুরাআন ও হাদিসে কি আছে, ঐতিহাসিক ঘটনা,  খ্রিস্টান ধর্মের ইতিহাস, ক্রুসেড, রাশিয়ার ইতিহাস, বিশেষ করে সোভায়েত রাশিয়ার সাথে ইসলামের বৈরিতা,  ইহুদি  খ্রিস্টান ধর্মে মালহামার ধারনা, ও সর্বশেষ বর্তমান বিশ্ব রাজনীতি। এই সকল বিষয় পর্যালোচনা করার পর আমরা চিহ্নিত করতে পারবো হাদিসের রুম, ও কুরআন কারিমায় কোন  খ্রিস্টানরা আমাদের মিত্র হবে বলা ধারনা দেয়া হয়েছে তা বুঝা যাবে।

প্রথম অনুচ্ছেদ
খৃষ্টবাদ নাকি পৌলবাদ! ক্যাথোলিক ও অর্থডোক্সের বিশ্বাস  

বর্তমান খৃষ্ট ধর্মের মূল বিশ্বাস হলো ত্রিত্ববাদ। তিন মিলে অর্থাৎ পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার সমষ্টি হল ঈশ্বর। এখানে পিতা হল মূল, জ্ঞান বা কালাম গুন হল পুত্র এবং পিতা পুত্রের মাঝে যে ভালোবাসার গুন সেটা পবিত্র আত্না। তবে এই সব হল আসলে জগাখিচুড়ি কিছু বিশ্বাস যা অস্পষ্ট। তাই খৃষ্ট পণ্ডিতরা সবাই আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা করেন। আসলে এটা কখনো হতে পারেনা যে, ইসরাইলী ধারায় যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা একটা সঠিক ধর্ম তার মূল বিষয় তাওহীদ কে বাতিল করে দিয়ে নবীকেই আল্লাহর পুত্র বানিয়ে দিবে।

ইহুদিদের বিভিন্ন সময় বলা হয়েছিল যে তোমাদের মাসিহা আসছেন, ইয়াহহিয়া (আঃ) এর আগমন হলে তারা তাকে জিজ্ঞাস করেছিল তুমি কি মাসিহা? তিনি জবাবে বলেছিলেন না তবে যিনি আমার থেকে শক্তিশালী তিনি অচিরেই আগমন করবেন। এর পরে ইহুদিরা ইয়াহিয়া (আঃ) কে মসজিদে শহীদ করে দিল। এর কিছু সময়ে পরেই ঈসা (আঃ) নবুওয়াতের দাবী করলেন। উনার এত মজেজা দেখা সত্ত্বেও  ইহুদিরা সোলাইমান (আঃ) এর মত রাজ্য না পাওয়ায় তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করলো এভাবেই আল্লাহ ঈসা (আঃ) কে উঠিয়ে নিলেন।

ঈসা (আঃ) চলে যাওয়ার পর উনার দাওয়াত প্রচার শুরু করলেন উনার সাহাবীরা তাদেরকে হাওয়ারী বলা হত। এদের মধ্যে মোট ১২ জন নির্ভরযোগ্য হাওয়ারির নাম পাওয়া যায়। তারা ঈসা (আঃ) এর শিক্ষা ও বাণী সংরক্ষণ করতেন এদের মধ্যে ৪ জনের, মথি, মার্ক, লূক ও ইউহান্না’র ইনজীলকেই  খ্রিস্টানরা ধর্মের মূল হিসেবে বিশ্বাস করে।

অবাক করার বিষয় হল  খ্রিস্টানদের মূল বিশ্বাস ত্রিত্ববাদকে বাইবেলের কোন কিতাবেই স্পষ্ট ভাবে পাওয়া যায় না। বর্তমান  খ্রিস্টানরা যে মতবাদে বিশ্বাসী আসলে তার প্রবক্তা ঈসা (আঃ) নন বরং সেন্ট পৌল এই নিয়মনীতি তথা ঈসা (আঃ) এর নাম ব্যবহার করে এক নিজস্ব চিন্তা ধারা প্রচার করেন।

ঈসা (আঃ) কে উঠিয়ে নেয়ার পর তার ১২ জন হাওয়ারি খুব অত্যাচার নির্মমতা সহ্য করে দাওয়াত পরিচালনা করছিলেন। এর কিছু বছর পর ইহুদিদের প্রসিদ্ধ রাবি শৌল হটাৎ  খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করে নিল এবং নাম বদলে নতুন নাম রাখলো পৌল। আসল ঘটনা ছিল পৌল যখন দেখল কোন ভাবেই ঈসা (আঃ) এর এই নতুন ধর্মকে দমানো যাচ্ছে না তাই সে তিন বছরের জন্য আরবে (দক্ষিণ শামে) ভ্রমন করে এক নতুন বিশ্বাস ও চিন্তা চেতনা নিয়ে এলো খৃষ্ট ধর্মকে বিকৃত করার জন্য। এসে সে দাবী করলো যে দামেস্কের রাস্তায় আকাশ থেকে ঈসা (আঃ) নেমে এসে তাকে  খ্রিস্টান ধর্মের দীক্ষা দিল। এই ঘটনা সত্ত্বেও ঈসা (আঃ) এর হাওয়ারীরা তাকে বিশ্বাস করলো না তবে এক প্রসিদ্ধ হাওয়ারি বার্নাবাস তাকে মেনে নিল এবং এক সাথে উভয়ে দাওয়াত শুরু করল।

দাওয়াতের কাজ চলছে তবে একসময় খ্রিস্ট ধর্মের নেতা সেজে বসা পল (মূলত ইহুদি) একত্ববাদী খ্রিস্ট ধর্মগ্রন্থ ইঞ্জিলকে বিকৃত করে এতে অযৌক্তিক ত্রিত্ববাদ চালু করায় বিশাল বিরোধ লাগল বার্নাবাস ও পৌলের মধ্যে। পৌল একদম আলাদা এক বিশ্বাস ছড়াচ্ছে, সে ত্রিত্ব নামে এক আজিব আকিদায় বিশ্বাস করে,ঈসা (আঃ) কে আল্লাহর পুত্র বলে প্রচার করল। তাই বার্নাবাস সহ বাকি সকল হাওয়ারী তার বিরোধিতা করল।

উদ্ধার হওয়া বার্নাবাস বাইবেল
পৌলবাদ এক চরম বাতিল ও কুফুরি মতবাদ ছিল তাই বার্নাবাস পৌল সম্পর্কে বলেন, আল্লাহ নবী ঈসা মাসীহের মাধ্যমে আমাদেরকে এক মহা রহমত দ্বারা পরীক্ষা করেছেন- সেই শিক্ষা ও নিদর্শন দান করে, যাকে শয়তান বহু লোককে গোমরাহ করার মাধ্যম বানিয়েছেন। যারা ধার্মিকতার নামে মারাত্মক কুফুর প্রচার করছে মাসিহ কে আল্লাহর পুত্র বলছে... (বার্নাবাস ১:২-৯)


বিরোধ আস্তে আস্তে চরমে পৌঁছল।  ইহুদি  খ্রিস্টানরা (যারা ইহুদি থেকে খৃস্টান হয়েছে) হাওয়ারীদের পক্ষে ছিল তবে অনেক নতুন  খ্রিস্টান তথা ইউরোপীয়  খ্রিস্টানরা পৌলের পক্ষে ছিল। এইভাবেই খৃষ্টধর্মের প্রথম তিন শতাব্দীতে পৌলীয় চিন্তাধারার বিরুদ্ধমত ছিল অনেক। চতুর্থ শতাব্দীতে আরিউস ও তার অনুসারীরা ত্রিত্ববাদের বিরুদ্ধে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ফলে পৌলবাদ পুরো দমিয়ে গেল ও গোপনে পালিত হচ্ছিল।




প্যাগান রোমের কলসিয়াম স্টেডিয়াম
অন্যদিকে রোমানরা  খ্রিস্টানদের উপর অত্যাচার শুরু করলো। চার্চ ও বই পুস্তক সব ভেঙ্গে জালিয়ে দিত, গ্ল্যাডিয়েটরের কলসিয়াম ময়দানে  খ্রিস্টানদেরকে ক্ষুধার্ত সিংহের সামনে ছেড়ে দেয়া হত। পরিস্থিতি হটাৎ বদলে যায় চতুর্থ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে সবাইকে অবাক করে গ্রেট কন্সতান্তিন খৃষ্টধর্ম গ্রহন করল আর সম্পূর্ণ পৌলের চিন্তা ও আকিদায় বিশ্বাস স্থাপন করলো।




কলসিয়াম স্টেডিয়ামে খ্রিস্টানদের হত্যাকে দর্শকরা উপভোগ করছে
এইভাবে ৩২৫ সালে নিকিয়া কাউন্সিল আহবান করে সেখানে সর্ব স্বীকৃতে পৌলবাদকেই মূল  খ্রিস্টান আকিদা বলে সাব্যস্ত করে ত্রিত্ববাদের বিরোধীদের কে ধর্ম থেকে খারিজ ঘোষণা করলো। এই ফয়সালায় ইউরোপীয়  খ্রিস্টানরা আনন্দ করলো এবং পূর্বাঞ্চলীয়রা এর চরম প্রতিবাদ করল আর পরিশেষে দমন-নিপীড়নে প্রতিবাদ নিস্তেজ হয়ে গেল।





পিটার মনে করে রোমান গড জুপিটারের পাকে চুমু খাচ্ছে ক্যাথোলিকরা
যাইহোক কন্সতান্তিন  খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করায় প্রাচীন গ্রিক ও রোমান এর মূর্তি পূজারীরা তাদের ধর্ম ও মূর্তি পুজার ধ্যান ধারনা খৃষ্টবাদ তথা পৌলবাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল যাতে  খ্রিস্টানরাও তাদের সাথে মিলে মিশে তাদের ধর্ম মানতে পারে। তারা তাদের প্রতিমার গুলোর নাম  খ্রিস্টান নামের সাথে মিলিয়ে দিল যেমন মেরি, পৌল ও পিটার। মিশরের গড আইসিস কে মেরি নাম দিয়ে তার কোলে এক সন্তানের মূর্তি দিয়ে দেয়া হল, ( খ্রিস্টানরা যাকে মারিয়ামের কোলে ঈসা মনে করে) একই ভাবে রোমান গড জুপিটারের মূর্তি হয়ে গেল পিটারের স্ট্যাচু অথচ এই  খ্রিস্টানরা কখনো চিন্তা করলো না পিটারের মাথায় রোমান সূর্য দেবতার প্রতিক কেন থাকবে। আর এই ভাবেই যেখানে মূর্তি পূজাকে টেন কম্যান্ডমেন্টে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা সত্ত্বেও ঈসা (আঃ) এর মূর্তি উপাসনা করতে লাগল। ছবিতে মিশরীয় গড আইসিসের কোলে গড  হোরাস বামদিকে মেরির কোলে জিসাস।



ইবলিশের কারসাজি তাই রূপ একই  নাম ও সংস্কৃতি ভিন্ন

জার্মানরাও এই সময় পৌলবাদ গ্রহন করল। পোপ এর ক্ষমতা রাজা থেকেও বেশি হওয়ায় কন্সতান্তিন রাজ্য চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলো। এভাবে এক সময় বর্বর জার্মানিদের হাতে পশ্চিম রোমান অনিরাপদ হয়ে গেলে কন্সতান্তিন তার দ্বিতীয় রাজধানী কে কন্সতান্তিনোপল নাম দিয়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রারম্ভ করে।

অর্থডোক্স, ক্যাথোলিক ও প্রোটেস্টেন্টদের মধ্যে পার্থক্য
এভাবে এক সময় খৃষ্ট ধর্ম দু’টি সাম্রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর একটি ছিল পূর্বাঞ্চলীয় তথা অর্থডোক্স  খ্রিস্টানরা। এর রাজধানী ছিল কন্সতান্তিনপোল। বলকান, ইউনান, এশিয়া মাইনর, মিশর, হাবশা প্রভৃতি অঞ্চল নিয়ে গঠিত। এদের চার্চের নাম হল হলি অর্থডোক্স চার্চ আর ধর্মীয় গুরুর নাম হত প্যাট্রিয়াক। বাইজেন্টাইন রাজারা পৌলবাদ ও খৃষ্টবাদ উভয় ধর্মে সামজস্য রেখে এক অভিন্ন ধর্ম বানিয়ে প্রজাদের উপর অনেক জুলুম করতো তাই অনেক বৈরাগবাদ ও মঠ গড়ে উঠলো। আর এই জুলুমের কারনেই মিসরে মুসলিম অভিযানে অর্থোডক্স নেতা বেনয়ামিন বাইজেন্টাইন রাজা হেরাকলকে কোন প্রকার সাহায্য করেন নি।



বাম দিকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য ডান দিকে পূর্ব রোমান বা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য
আরেক সাম্রাজ্য হল ওয়েস্টার্ন রোমান এম্পায়ার, এর রাজধানী ছিল (বর্তমান ইতালির শহর) রোম। ইউরোপের অধিকাংশ এলাকাই ছিল এর অধীনে। ক্যাথলিক চার্চ আর ধর্মীয় গুরুর নাম হত পোপ। যা আজও চলে আসছে বর্তমান পোপের নাম পোপ ফ্রান্সিস। এরা পুরো পৌলবাদ তথা ত্রিত্বসহ, ব্যাপ্টিজম, ক্রুসিফাইড, আদি পাপ ইত্যাদিতে বিশ্বাস করে।



বামদিকে প্যাট্রিয়াক ডানদিকে পোপ
অন্যদিকে অর্থডোক্সের বিশ্বাস হল কোন প্রতিমার পূজা করা যাবে না এমনকি সম্রাট লিও ৩ সকল চার্চ থেকে সকল প্রকার মূর্তি বের করে দিয়েছিলেন। যাইহোক এভাবে এদের এখানে দরবেশ ধারণা প্রসার পাই, তাই অনেক প্রসিদ্ধ রাহেব/সন্ন্যাসী তৈরি হয় এদের মধ্যে থেকেই আমরা দেখি যে কি ভাবে সালমান ফার্সি (রা) সত্যের সন্ধানে ঘুরতে থাকেন। এরা যিশুর জন্মদিন ৭ জানুয়ারিতে পালন করে এবং ক্যাথোলিকরা ২৫ ডিসেম্বর।





লিখেছেনঃ  Kaisar Ahmed

ট্যাগ
রোমান, রোমক, বাইজেন্টাইন, অর্থোডক্স, রোমান ক্যাথোলিক, সূরা রুম, রোমান এম্পায়ার, ত্রিত্ববাদ, ক্রুসেড, আখেরী জামানা, ইহুদি, মালহামা, ঈসা