Monday, December 25, 2017

Blog Administrator

রুম কে? আমেরিকা না রাশিয়া, অর্থোডক্স না ক্যাথোলিক - ঐতিহাসিক ও ধর্মতাত্ত্বিক পর্যালোচনা (৩য় অনুচ্ছেদ)


তৃতীয় অনুচ্ছেদ

কনস্টান্টিনোপল পতনের পর অর্থোডক্সরা পর্ব ইউরোপে নিজেদেরকে দৃঢ় করে প্রতিষ্ঠিত করে, এভাবেই একসময় রাশিয়া তাদের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সময় গড়িয়ে যায় ক্যাথোলিক থেকে প্রটেস্ট করে এক প্রটেস্টেন্ট নামক ভিন্ন মতবাদ তৈরি হয় পরে এদের বেশির ভাগই আমেরিকায় পাড়ি জমায়। এর পরে এক এক করে বিপ্লব হতে থাকে আর (ক্যাথোলিক) পেগানদের থেকে তাদের ধর্মীয় যা কিছু শেষ শিক্ষা/আধ্যাত্মিকতা ছিল তাও হাড়িয়ে যায়। ধর্মীয় আধ্যাত্মিক শক্তি, জ্ঞান, মূল্যবোধ নিয়ে তখন এক মাত্র মুসলমানরাই পুরোদমে এক খিলাফতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে ও সাথে ঈসা (আঃ) তথা মাসিহার কিছু শিক্ষা নিয়ে অর্থোডক্সরা কোন মতন টিকে থাকে।

এরপর জায়নিস্টরা পরিকল্পনা করে মুসলিম ও অর্থোডক্সদের পুরোপুরি ভাবে ধর্মীয় আধ্যাত্মিক ও মূল্যবোধ শেষ করে দিতে হবে। ইহুদিরা ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে ১৭৮৯ সালে ক্যাথলিকজমকে ধ্বংস করে দিয়েছিলো। এভাবে তারা অর্থোডক্সিজমকে ধ্বংস করে দিতে ১৯১৭ বলশেভিক রেভুলিউশন ঘটিয়ে সম্পূর্ণভাবে সোভায়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা করে ধর্মীয় শিক্ষা পুরোপরি বাদ করে দিয়ে নাস্তিকতা তে সয়লাব করে দেয়।

সোভায়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিজম বনাম মুসলিম

৭ম শতাব্দীর শুরুতে ককেসিয়ার ডারিয়াল গর্জ গিরিপথের সম্মুখের প্রাচীর ভাঙ্গার পর যারা বের হয়েছিল তাদের মধ্যে থেকে কিছুরা ইহুদি ধর্ম গ্রহন করেছিল তারাই পরিবর্তিতে যাওয়নিস্ট গ্রুপ তৈরি করে। বর্তমান বিশ্বের মোট ইহুদিদের মধ্যে এরাই শতকরা ৯০ ভাগ। অবাক হওয়া বিষয় হল যারা ইহুদিদের জন্য এত সংগ্রাম করছে তারা কপ্টিক অর্থাৎ মূল ইয়াহুদা বিন ইয়াকুব এর সন্তান নয় বরং নওইহুদি এরাই হল জায়নিস্ট। এরা ১৮৯৭ সালে জায়নিস্ট গ্রুপ গড়ে তুলে জেরুজালেমে ইহুদি শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য। পরে নিজেদের একছত্র শাসন কায়েম করার জন্যই ১৯৪৮ সালের মাত্র ৫/৬ বছর আগে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে এমন অবস্থা তৈরি করেছিল যার ফলে হিটলার হলোকাস্ট চালিয়ে প্রায় ৬০ লক্ষ মূল ইহুদিদের হত্যা করেছিল ফলে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে এই জায়নিস্টরাই সংখ্যা-গরিষ্ঠ হয়ে একছত্র ভাবে শাসন করছে। আর মূল ইহুদিরা ইসরাইলে সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন হয়ে বসবাস করছে।  

যাইহোক সেই ৭ম শতাব্দী থেকেই কিছু ইহুদি ককেশীয় অন্ধলে বসবাস করছিল যা পরে রাশিয়া দখল করে নেই এভাবে রাশিয়ার সাথে ইহুদিদের শত্রুতা লেগেই থাকে। রাশিয়ানরা সর্বশেষ উনবিংশ শতাব্দীতে ইহুদিদের উপর গনহত্যা চালাই যাতে প্রায় ২ লক্ষ ইহুদি মারা যায়। ইহুদিরা ১৮৮১ সালে জার সম্রাট অ্যালেকজান্ডারকে গুপ্তহত্যা করে ১৯০৫ সালে জারের বিরুদ্ধে সেন্ট পিটার্সবার্গে বিপ্লব সংঘটিত করে। পরে  লিয়ন ট্রটস্কি এই বিপ্লবের পূর্ণতা দেয়। 

কমিউনিস্ট মতবাদের প্রবর্তক হলেন জায়নিস্ট ইহুদি কার্ল মার্ক্স, সে ইহুদি ধর্ম গুরু মোর্দেখাই মার্কসের পৌত্র। বলশেভিক বিপ্লবে যে ৭ জনের মূল ভূমিকা ছিল তারা সবাই ইহুদি- লেনিন, লিয়ন ট্রটস্কি, লেভ কেমনেভ, গিওর্গি, ঝিনো নেভ, স্ট্যালিন (এর মা ইহুদি ছিলেন নাম রোসা কাগানোভিচ), ইয়াবানোভ। এদের ইয়াবানোভ বাদে সবাই জায়নিস্ট ইহুদি ছিলেন।    

লেনিন যখন রাশিয়ায় প্রবেশ করে,তার সঙ্গে তখন ২২৪ জন বলশেভিক বিপ্লবী ছিল যাদের মধ্যে ১৭০ জনই ছিল ইহুদি, আর লিয়ন ট্রটস্কি বর্ডারে কয়েকহাজার ইহুদি সৈনিক নিয়ে লেনিনকে স্বাগতম জানাই। এই বিপ্লবে প্রায় ২৮ লক্ষ শুধু রাশিয়ান সৈন্য নিহত হয়। সোভায়েত ইউনিয়নের সম্পূর্ণ শাসনে প্রায় ৩৫ লাখ অর্থোডক্স রাশিয়ানকে হত্যা করা হয়েছিল।



সোভায়ের কর্তৃক অর্থোডক্স রাশিয়ানদের গনহত্যা
আর বাকি দের অর্থের বিনিময়ে কিনে নেয়া হয়েছিল। বিজয়ের সাথে সাথে জায়নিস্ট নেতারা এই মেসেজ প্রচার করেছিলেন নিজেরদের মধ্যে- “হে ইয়াহুদ জাতি, আমাদের পূর্ণাঙ্গ বিজয়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে, আমরা এখন আশাবাদী যে একদিন আমরা বিশ্বের নেতৃত্ব গ্রহন করবো। রাশিয়ায় আমরা কর্তৃত্ব গ্রহন করতে পেরেছি; রুশরা ছিল আমাদের নেতা এখন তারা আমাদের দাসে পরিনত হয়েছে।”





১৯৩১ সালে christ saviour cathedral (চার্চ) কে বোমা
দিয়ে ধ্বংস করে দেয় কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন
অবাক করে যে এই কম্যুনিজমের কারনে ২-৩ কোটি অর্থোডক্স, লক্ষ লক্ষ মুসলিম, ও লক্ষাধিক বৌদ্ধ নিহত হয়েছিল। কিন্তু ইয়াহুদী ও ক্যাথোলিকরা সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল। যদিও দুই কোরিয়ার লড়ায়ের কিছু নওক্যাথোলিক নিহত হয়।

যাইহোক, বিজয়ের প্রথম সপ্তাহে ইহুদিদের অধিকার রক্ষায় দুই দফা বিশিষ্ট একটি প্রস্তাব প্রকাশ করে-

১. ইয়াহুদী জাতির প্রতি শত্রুতাকে সর্বচ্চো জাতির প্রতি শত্রুতা বলে গণ্য করা, তার জন্য আইনত দণ্ড প্রদান। 
২. ফিলিস্তিনের ভূমিতে একটি জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের অধিকার ইহুদিদের রয়েছে বলে স্বীকৃতি প্রদান।   
বিপ্লবের পর থেকে পুরো সোভায়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে, প্রশাসনের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই হত ইহুদি কর্মকর্তারা। প্রধানমন্ত্রী, উপ-প্রধানমন্ত্রী, অর্থ-মন্ত্রী, সবাই ইহুদি ছিল। বিশ্ব-বিদ্যালয়ের শতকরা ৬০ ভাগ শিক্ষক ছিল ইহুদি।




পাদ্রী কে সোভায়েট কোর্ট রায় শুনাচ্ছে।
Alexander Nikolaevich Yakovlev এর মতে
সোভায়েতরা প্রায় ১ লক্ষ পাদ্রীকে হত্যা করে
এ ভাবে অর্থোডক্সিজমকে পুরো ধ্বংস করে দেয়া হয় আর নাস্তিকতার প্রচার প্রসার শুরু করে। রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চকে বন্ধ করে দেই তাদের বাইবেল পুড়িয়ে দেই, পাদ্রী ও দরবেশদেরকে হত্যা করা হয় আর যারা ধর্ম পালন করতো তাদেরকে হত্যা নয় তো লেবার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হত। একই অবস্থা করে মুসলিমদের সাথেও যা আমরা প্রায় সকলেই জানি। পুরো সময় ধরে সোভায়েত ইউনিয়নের কাজ ছিল মূলত ইসরাইলকে যথাসম্ভব ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পুরো সহায়তা করা, তার আশেপাশের মুসলিম বিশ্বে কমিউনিস্ট তথা নাস্তিকতার প্রচার প্রসার, ও রাশিয়া কে কেন্দ্র করে হাঙ্গেরি, যুগোস্লাভিয়া, রোমানিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, বলোঙ্গা তথা পুরো পূর্ব ইউরোপে অর্থোডক্সদের মধ্যে নাস্তিকতার প্রচার ও এদেরকে উত্তেজিত করে মুসলিম নিধন। এইভাবে নাস্তিক সোভায়েতরা এক সময় মুসলিম নিধনে শুরু করে।




স্ট্যালিনের যুগে (১৯২৯-৫৩) গনহত্যার ছবি।
 পুরো সোভায়েতের সময় প্রায় ৩ কোটি রাশিয়ান,
বসিনেনিয়ান, চেচেনিয়ান মুসলিম ও অর্থোডক্সদের কে হত্যা করা হয়
আর অর্থোডক্স ও মুসলিমদের মধ্যে এক চির শত্রুতার চিন্তা গড়ে তুলে। (যদিও রাশিয়ান জার শাসনের সময় ককেসিয়া ও উসমানীয় খিলাফতের সাথে সংঘাত সব সময় লেগে থাকতো ইমাম শামিলের ইতিহাসে আমরা সবাই জানি যাইহোক এটাকে দুই সাম্রাজ্যের আধিপত্যের লড়াই বলা যায় কিছুতেই ধর্মীয় যুদ্ধ বলা যায় না।) অথচ মুসলিমরা হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগ শিকার হয়েছিল নাস্তিক রাশিয়ানদের থেকে যারা আগে অর্থোডক্স ছিল। সোভায়েত ইউনিয়ন পুরো অর্থোডক্সিজমকে ধ্বংস করে দেই। আর সেই অঞ্চলে থাকা মুসমানদের কেও এইভাবেই শেষ করে। সর্বশেষ আফগানিস্তানেও তারা ঢুকে পরে আর সেটাই এই নাস্তিক ও ইহুদিদের জন্য কাল হয়ে দারায়। আর পরিশেষে সোভায়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে টুকরো হয়ে যায় আর এর সাথে সাথে নাস্তিকতা মিটে আবার অর্থোডক্সরা আবার নিজের ধর্মকে আকড়ে ধরে।       


ইহুদি-খ্রিস্টান সম্পর্ক

ঐতিহাসিক ভাবেই খ্রিস্টানরা ইহুদিদেরকে প্রধান শত্রু মনে করত। কারন তারা মনে করে ঈসা (আঃ) কে ইহুদিরা শূলীবিদ্ধ করে হত্যা করেছে। তাই যখনই খ্রিস্টানরা ক্ষমতা লাভ করেছিল তখন থেকেই তারা ইহুদিরের উপর নির্মম অত্যাচার চালাতো আর ইহুদিরা উদ্ভ্রান্তের মত সারা বিশ্বে ঘুরে বেরাত।

প্রথম ক্রুসেড ১০৯৬ঃ জার্মান ক্রুসেডরা
 ইহুদিদের হত্যা করছে (Rhineland massacres)
ক্রুসেডাররাও সব চেয়ে প্রথমে হত্যাকাণ্ড চালায় ইহুদিদের উপর। ১০৯৬ সালা ফ্রান্স ও জার্মানের ক্রুসেডাররা ইহুদি সম্প্রদায়ের উপর হামলা করে অনেক ইহুদি কে হত্যা করে ইতিহাসে এটা Rhineland massacres নামে পরিচিত। এর পরে যখন ১০৯৯ জেরুজালেমে প্রথম ক্রুসেড হয় তখন মুসলিমদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে ইহুদিরা লড়াই করেছিল।









১০৯৯ সালে জেরুজালেমের পতনের পরে খুঁজে খুঁজে ইহুদি নিধন করছে ক্রুসেডাররা
পরাজয়ের পর ক্রুসেডরা প্রায় ৭০,০০০ মানুষকে হত্যা করে। এই নির্মমতা ইতিহাসে খুব কম পাওয়া যায়, এখানে মুসলমানের সাথে ইহুদিদেরকেও হত্যা করা হয়। ইবনে আল কালিনিসি লিখেন- ‘ইহুদিদেরকে তাদের ধর্মালয়ে জোড় করে দরজা লাগিয়ে পুরো ইবাদতখানায় আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।’ ইহুদি গির্জা কানিসাতে ক্ষতবিক্ষত ইহুদিদের লাশের স্তূপ দেখে ক্রুসেডের অন্যতম নেতা পোপ রেমন্ড কে পত্রে লিখেছেন-“এই দিনটি ঈশ্বর আমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আসুন আমরা উল্লাস করি এবং এতে আনন্দিত হই” 

এই ভাবে ইহুদি খ্রিস্টান সম্পর্ক সব সময় খারাপ ছিল ১৪৯২ সালে যখন মুসলিমদের কে আন্দালুসিয়া থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল তখন ইহুদিদের কেও বের করে দেয়া হয় পরে উসমানীয় খিলাফতের জাহাজ মুসলিমদের সাথে তাদেরকেও উদ্ধার করে। 

কিন্তু যত বছর গড়াচ্ছিল ক্যাথলিকরা ততটাই ইহুদিদের কে বরণ করে নিচ্ছিল উনবিংস শতাব্দীতে ইউরোপে ইহুদিরা অনেক ক্ষমতা লাভ করে এই ভাবেই খ্রিস্টান তথা ক্যাথোলিকরা জায়নিস্টের পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাহায্য করে। এমনকি জেরুজালেম এ তাদেরকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে তাদেরকে সুপার পাওয়ার বানিয়ে দিয়েছে। আর সর্বশেষ ১৯৬২ সালে ক্যাথোলিক চার্চের পক্ষ থেকে এত বছরের ঈসা (আঃ) এর হত্যার জন্য ইহুদিদেরকে যে দোষারোপ করা হচ্ছিল সেটা থেকে অব্যাহতি ঘোষণা করেন ২৩ তম পোপ জন। এবং বললেন, সকল ইহুদি নয় বরং সেই সময় নেতৃস্থানীয় কিছু ইহুদি এর জন্য দায়ী আর খ্রিস্টান ও ইহুদিদের সম্পর্ক আরো উন্নত হওয়া উচিত। অবাক হই কেন এত দিন পরে ইহুদিদেরকে এক আদি পাপ থেকে মুক্ত ঘোষণা করলো ক্যাথোলিকরা যেখানে অর্থোডক্সরা এখন ইহুদিদের কে গুনাহগার মনে করে।


লিখেছেনঃ Kaisar Ahmed

ট্যাগ
রোমান, রোমক, বাইজেন্টাইন, অর্থোডক্স, রোমান ক্যাথোলিক, সূরা রুম, রোমান এম্পায়ার, ত্রিত্ববাদ, ক্রুসেড, আখেরী জামানা, ইহুদি, মালহামা, ঈসা, কনস্টান্টিনোপল, ইহুদি খ্রিস্টান